মন ভাল তো দেহ ভাল
হাসি
সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এটা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেবার মত তথ্য না। এর
পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ আছে।
হাসলে
মুখ আর পেটের পেশি রিল্যাক্সড হয়। ফুসফুস এবং হৃৎপিণ্ডে প্রচুর অক্সিজেন পৌছায়। এজন্য
হাসিকে বলা হয় ইন্টারনাল জগিং। হাসি অনিদ্রা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যারা সবসময়
হাসিখুশি থাকেন তাদের স্মৃতিশক্তি আর শেখার ক্ষমতাও বেশি থাকে।
গবেষণায়
দেখা গেছে ১০ মিনিটের উচ্ছল হাসি দু ঘন্টা পর্যন্ত ব্যাথা মুক্তির কাজ করতে পারে।
কারণ হাসলে আমাদের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে এনডোরফিন নামের একটা হরমোন
নিঃসৃত হয় যেটা ব্যাথার অনুভূতি কমিয়ে দেয়। তাই হাসি টেনশনজনিত মাথাব্যাথা এবং
মাইগ্রেন নিরাময়ে শক্তিশালী ভুমিকা পালন করে।
এ ছাড়াও
হাসি মনের বোঝা কমায়, মনকে ভারমুক্ত করে। ফলে মনোদৈহিক রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা কমে
যায়।
হাসির যে
এত উপকার সেটা আমরা এতদিন পরে গবেষণা করে জেনেছি। অথচ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ
বছর আগে মহানবী (সঃ) বলেছেন, হাসিমুখে কথা বলা সাদাকা। তিনি বলেছেন কারো সাথে দেখা
হলে সালাম দিতে আর হাসি মুখে কুশল জিজ্ঞেস করতে। কেন বলেছেন সেটা আমরা এতদিন পর
গবেষণা করে বুঝতে পারছি।
একজন
জাপানী সাধকের কথা বলি। তার নাম ছিল হো-তেই। তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে, বাজার থেকে
বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। গ্রামের মাঠ বা বাজারের মাঝখানে দাঁড়াতেন। তারপর হাসতে শুরু
করতেন। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতেন। তার হাসি যেমন প্রাণবন্ত ছিল, তেমনি ছিল
ছোঁয়াচে। তাকে হাসতে দেখে চারপাশের সবাই হাসতে শুরু করত। তারাও হাসতে হাসতে মাটিতে
গড়াগড়ি খেত। আর এভাবে হাসতে হাসতে তারা তাদের দুঃখ, দুর্দশা, শোক আর হতাশা ভুলে
যেত। বিভিন্ন মনোদৈহিক
রোগ থেকে মুক্তি পেত। এ কারণে গ্রামবাসীরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করত, কবে হো-তেই আসবেন। কবে তারা
প্রাণ খুলে হাসবে। কারণ তারা জানত হাসিতে রোগ সারে।
এখন
প্রশ্ন হল আমরা কি হাসতে পারি?
মুখে যতই
বলিনা কেন, আমরা আসলে অনেকেই মন খুলে হাসতে পারিনা। কারও হয়তো বাসায় অসুস্থ রোগী
আছে, কারও ব্যবসা ভাল যাচ্ছেনা, কেউ হয়তো চাকরি পাচ্ছেন না আবার কেউ কেউ অফিস
পলিটিক্সের শিকার, অনেকে পরিশ্রম করেও পড়াশোনায় ভাল করতে পারছেন না, আর কারও হয়তো
সবচেয়ে কাছের মানুষটার সাথেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। এরকম বিভিন্ন ধরণের দুঃখ
আমাদের জীবনের হাসি কমিয়ে দিয়েছে। কারণ মানুষ যখন টেনশনের মধ্যে থাকে তখন তার হাসি
আসেনা।
তাই
নিজেকে ভাল রাখতে হলে টেনশন ঝেড়ে ফেলাটা অত্যন্ত জরূরী। জীবনে সমস্যা আসতেই পারে। কিন্তু আমাদেরকে
তার মধ্যেও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। টেনশন ঝেড়ে ফেলা শিখতে হবে।
ছোট খাট
টেনশনও আমাদের যে কত বড় ক্ষতি করতে পারে সেটা একটা উদাহারণ দিয়ে বোঝাই।
ধরুন
একটা পানির গ্লাস। কতটুকু আর ওজন হবে ? ২০০ গ্রাম বা ২৫০ গ্রাম ? এখন কাউকে যদি বলি
যে ভাই বা আপা গ্লাসটা একটু ধরবেন প্লিজ? তিনি অনায়াসে গ্লাসটা ধরে রাখতে পারবেন।
পাঁচ মিনিট এরকম একটা গ্লাস হাতে রাখা কোনো ব্যাপার না। দশ মিনিটও পারা যাবে।
কিন্তু ১৫ মিনিট পরে দেখবেন হাতটা একটু ভারি ভারি লাগতে শুরু করেছে। ২০ মিনিট পরে
ব্যাথা শুরু করবে। এর পরে যত সময় যাবে ব্যাথা বাড়তে থাকবে। এভাবে ব্যাথা বাড়তে
বাড়তে এক সময় মনে হবে হাতটাই যেন ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। দেখেন ছোট একটা গ্লাস। কিন্তু
তার প্রভাব কত। টেনশনের ব্যাপারটাও সেরকম। টেনশন যতই ছোট হোক না কেন সেটা যদি আমরা
মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াই তাহলে সময়ের সাথে সাথে ক্ষতির পরিমানও বাড়তে থাকে। তাই
টেনশন ঝেড়ে ফেলাটা অত্যন্ত জরুরী।
এখন
প্রশ্ন হল টেনশন কিভাবে ঝেড়ে ফেলব ?
টেনশন
ঝেড়ে ফেলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল মেডিটেশন। শিথিলায়ন তো আছেই এ ছাড়াও জীবনে
ছোট খাট কারণে কারও উপর যদি মেজাজ খারাপ হয়, রাগ - ক্ষোভের মেডিটেশন করে তাকে ক্ষমা
করে দিন। আসলে ক্ষোভ পুষে রেখে কোনো লাভ নেই। এতে নিজেরই ক্ষতি হয়। ক্ষোভ এমন এক
বিষ যা মানুষ নিজে পান করে, আর প্রতিপক্ষের মৃত্যু কামনা করে। তাই এরকম বিষ ঝেড়ে
ফেলাই ভাল। এতে টেনশন দূর হবে।
মনের বিষ
ঝেড়ে ফেলার পর দেখবেন মনটা অনেক হালকা লাগবে। নিজেকে ভারমুক্ত মনে হবে। আর আপনি
যখন শুকরিয়া বা আনন্দের মেডিটেশন করবেন তখন আপনার মন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে যাবে । আপনি প্রাণবন্ত হয়ে উঠবেন।
এই
মেডিটেশনগুলো কিন্তু ইন্টারনেটে দেয়া আছে। যে কেউ ফ্রি ডাউনলোড করে
নিতে পারেন।
আমরা যদি
কোনো একটা ঘরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে চাই তাহলে কি করতে হবে? প্রতিদিন ঘরটা
ঝাড়ু দিতে হবে, মুছতে হবে। মনের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। আমরা যদি নিয়মিত
মেডিটেশন করি তাহলে আমাদের মনের আবর্জনাগুলো দূর হবে, মন প্রফুল্ল হবে। আর মানসিক
প্রফুল্লতা নিরোগ দেহ সৃষ্টি করবে।
মেডিটেশন
কিন্তু মানুষকে নেতিবাচকতা থেকেও রক্ষা করে। নেতিবাচক কথা যে কত দ্রুত মানুষের
শরীরের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তার একটা ঘটনা বলি।
একটা
অফিসে কয়েকজন একই সাথে কাজ করেন। এরা একদিন ঠিক করলেন নেতিবাচক কথা বলে কাউকে
অসুস্থ করা যায় কি না পরীক্ষা করে দেখবেন।
তাদের অফিসে বেশ স্বাস্থ্যবান একজন ভদ্রলোক ছিলেন লোকমান সাহেব, তারা তাকেই
টার্গেট করলেন। একদিন তারা সবাই আগেই অফিসে এসে বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়ে
দাড়ালেন।
লোকমান
সাহেব যখন অফিসে আসলেন তখন অফিসের গেটে তাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন “কি ব্যাপার লোকমান সাহেব,
আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর ভাল তো? লোকমান সাহেব বললেন “আছি ভাই, ভালই আছি”।
আরেকটু
এগিয়ে যেতেই আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন “কি ব্যাপার লোকমান সাহেব আপনাকে এমন অসুস্থ দেখাচ্ছে কেন?
রাতে ভাল ঘুম হয়নি? লোকমান সাহেব তাকে বললেন “না না, ঘুম তো ভালই হয়েছে”। কিন্তু মনে মনে চিন্তা
করতে শুরু করলেন কি ব্যাপার? আমি মনে হয় সত্যিই অসুস্থ। না হলে পর পর দু জন একই
কথা বলবে কেন?
একটু
সামনে যাবার পর তৃতীয় জন বললেন, “লোকমান সাহেব, এই অসুস্থ শরীরে অফিসে আসার কি দরকার ছিল?
ফোন করে বলে দিলেই তো হত”। শুনে লোকমান সাহেবের হার্টবিট একটু বেড়ে গেল।
এর পর
চতুর্থ জন লোকমান সাহেবকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন ভাই আপনি বরং
আমার চেয়ারে বসে একটু বিশ্রাম নিন, পানি খান। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি”।
একটু পরে
ডাক্তার আসলেন। ততক্ষনে লোকমান সাহেব ঘামতে শুরু করেছেন, একটু একটু শ্বাসকষ্ট
হচ্ছে, কয়েকজন তাকে বাতাস করছেন। কিন্তু ডাক্তার চেকাপ করে কিছুই পেলেন না, শুধু
বললেন বিশ্রাম নিতে।
একটু পরে
সবাই এসে যখন লোকমান সাহেবকে এক্সপেরিমেন্টের কথা খুলে বললেন তখন তিনি হো হো করে
হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।
দেখেন
সামান্য কথার প্রভাব কতখানি। নেতিবাচক কথা একজন সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ করে ফেলে।
আসলে এই
ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে? টেনশন করলে আমাদের ব্রেইন বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেস হরমোন তৈরী
করে। এই স্ট্রেস হরমোনের কারণে ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়, হার্টবিট
বেড়ে যায়, হজমশক্তি কমে যায়, গ্রোথ হরমোন বন্ধ হয়ে যায় এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও
কমে যায়। কিন্তু মেডিটেশনে ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটে। মেডিটেশনের মধ্যে আমরা প্রায়ই একটা
কথা শুনি যে, মনের বাড়ি চেতনার এক শক্তিশালী স্তর। এই স্তরে মন দেহের প্রতিরক্ষা ও
নিরাময় ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগমুক্তির কাজে নিয়োজিত করে।
এটা
কিভাবে ঘটে? মেডিটেশনে আমাদের ব্রেইন ওয়েভ কমে। ফলে হার্টবিট কমে, দেহের রোগ
প্রতিরোধ ও নিরাময় ক্ষমতা বাড়ে।
আসলে
আমরা যখন স্ট্রেস ফ্রি হচ্ছি তখনই কিন্তু আমাদের নিরাময় ক্ষমতা বাড়ছে। অনেকে মনে
করতে পারেন যে জীবনে তো স্ট্রেস থাকতেই পারে। এটা আর এমন কি ?
কিন্তু স্ট্রেস শুধু যে আমাদেরকে ভোগাবে তাই না। আমাদের স্ট্রেসের কারণে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এমনকি পরবর্তী দুই প্রজন্মকেও ভুগতে হতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, একটি জনন কোষে থাকা ২৫,০০০ জিনের মধ্যে ২৩৩ টি জিনের মধ্যে স্ট্রেসের প্রভাব থেকে যেতে পারে। এর প্রভাবে পরবর্তী বংশধরের মধ্যেও হাইপারটেনশন দেখা দিতে পারে।
দিনাজপুর
থেকে এরকম একজন তরুণ অংশগ্রহণ করেছিলেন মেডিটেশন কোর্সে। ২২ বছর বয়স
তার। তিনি জন্মগতভাবে হাইপারটেনশনে ভুগছিলেন এবং এটা বংশগতভাবেই তার মধ্যে এসেছে। তার
অবস্থা এমন ছিল যে দু ঘন্টা পর পর তাকে ওষুধ খেতে হত। না খেলেই বুক ধরফর করত।
সেই তরুণ মেডিটেশন কোর্সে গিয়ে চারদিন ওষুধ ছাড়াই কাটিয়েছেন। বংশগত হাইপারটেনশন থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি
এতটাই আবেগাপ্লুত ছিলেন যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার
কাছে শুধু মনে হচ্ছিল যে ব্লাড ল্যাবে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে আসলে হয়তো
কিছুটা ঋণ শোধ হবে।
আসলে তার
ক্ষেত্রে কি ঘটেছে ? তার নিরাময়টা কিভাবে হয়েছে ? চারটা দিন তিনি হাসি খুশি আর
প্রশান্তির মধ্যে কাটিয়েছেন। বার বার মেডিটেশনে আলফা লেভেলে প্রবেশ করেছেন। এক সময়
তার ব্রেন স্ট্রেস হরমোনগুলোকে ম্যানেজ করা শিখে গেছে। ফলে তাকে হাইপারটেনশনের
জন্য আর ওষুধ খেতে হচ্ছেনা। নিয়মিত মেডিটেশন করলেই তার হাইপারটেনশন দূর হয়ে
যাচ্ছে।
আজকের
পুরো আলোচনায় মূল যে কথাটা আমি বলতে চেয়েছি সেটা হল “মানসিক প্রফুল্লতা নিরোগ দেহ
সৃষ্টি করে”। আর আমরা প্রাণবন্ত মানুষদের সাথে যত থাকব আমাদের মন তত
প্রফুল্ল থাকবে।
সেই প্রোগ্রামের গাইডও বিষয়টা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। উনি বলছিলেন যে, আমি আজকে
এমন একজন মানুষকে পাহাড়ে উঠতে দেখলাম যার উঠতে পারাটা আসলেই চ্যালেঞ্জিং।
আসলে এটা
হচ্ছে সঙ্ঘের শক্তি। সবাই যখন একসাথে পাহাড়ে গিয়েছে তখন উনিও মনোবল পেয়ে উঠে
গিয়েছেন। একা থাকলে এটা কখনও সম্ভব হতনা।
তাই আসুন আমরা সবাই সৎ সঙ্ঘের সাথে একাত্ম থাকি, পরিচিত সবাইকে উদ্বুদ্ধ
করি সৎ কাজের জন্যে। আজকের এই অস্থির, অশান্ত সমাজে প্রশান্তির বাণী ছড়িয়ে
দেই।
মহান
সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সুস্থ দেহ, প্রশান্তমন, কর্মব্যস্ত, সুখী জীবন দান করুন।
মন ভাল তো দেহ ভাল
- Product Code: মন ভাল তো দেহ ভাল
- Availability: Out Of Stock
-
Tk. 0
- Ex Tax: Tk. 0